কোটালীপাড়া নিউজ২৪ ডেস্ক :
নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এশিয়ার সাফল্যে ঈর্ষান্বিতই পশ্চিমা বিশ্ব। এশিয়ার মধ্যে আবার দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও হংকংকে দৃষ্টান্ত হিসেবে নিতে চান অনেকেই। কিন্তু একটি দেশের গল্প উপেক্ষিতই থাকছে-ভিয়েতনাম। ৯৭ মিলিয়ন মানুষের দেশটিতে এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি এবং শনিবার পর্যন্ত মোট আক্রান্ত শনাক্ত হয় ৩২৮ জন।
চীনের সঙ্গে ভিয়েতনামের রয়েছে দীর্ঘ সীমান্ত এবং প্রতি বছর লাখ লাখ চীনা নাগরিক ভিয়েতনামে আসেন। আর নভেল করোনাভাইরাসের সূচনা যেহেতু চীন থেকে, তাই ভিয়েতনাম বড় ঝুঁকিতেই ছিল। কিন্তু তারা এটি সফলভাবে রুখতে পেরেছে। তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের অন্যতম বড় প্রতিদ্বন্দ্বী এই ভিয়েতনাম কভিড-১৯ যুদ্ধে জিতে অর্থনীতিকেও সংহত করতে চলেছে। মহামারী থেকে প্রায় কাটিয়ে উঠে ভিয়েতনাম যখন ব্যবসা-বাণিজ্যে মনোযোগী হয়েছে ঠিক সেই সময় বাংলাদেশ কভিড-১৯ নিয়ে লড়াই করেই যাচ্ছে এবং এ লড়াইয়ের শেষ কবে তা কেউই জানেন না।
ভিয়েতনামের নাগরিকদের বার্ষিক গড় আয়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নভেল করোনাভাইরাস নিয়ে তাদের সাফল্য নজিরবিহীনই বলা যায়। দেশটির আয় নিম্ন-মাঝারি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও বলার মতো নয়। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবমতে, দেশটিতে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ডাক্তার রয়েছে আটজন, যা কিনা দক্ষিণ কোরিয়ার এক তৃতীয়াংশ।
দেশজুড়ে তিন সপ্তাহের লকডাউন শেষে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়মটিও সরকার তুলে নেয় এপ্রিল মাসের শেষ দিকে। সর্বশেষ ৪০ দিনের মধ্যে স্থানীয়দের মধ্যে কেউ শনাক্ত হননি। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও স্কুল খুলে দেয়া হয়েছে এবং মানুষ স্বাভাবিক জীবনে প্রবেশ করেছে।
সন্দেহবাদীদের কাছে ভিয়েতনামের মৃত্যুর এই সংখ্যাটি এতই ভালো যে বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের জন্য সরকার কতর্ৃক মনোনীত অন্যতম শীর্ষ হাসপাতালে কাজ করা সংক্রমণ রোগ বিষয়ক চিকিৎসক গাই থোয়াইটস জানান, সংখ্যাটির সঙ্গে বাস্তবতার সম্পূর্ণ মিল রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি প্রতিদিন ওয়ার্ডে যাই, শনাক্তদের ব্যাপারেও জানি, আমি সেখানে কোনো মৃত্যু দেখি না।’
হো চি মিন শহরের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল রিসার্চ ইউনিটের প্রধান গাই আরো বলেন, ‘আপনি যদি রোগের ব্যাপারটি গোপন করেন কিংবা অনিয়ন্ত্রিত সামাজিক সংক্রমণ ঘটে যায় তবে মানুষ কিন্তু হাসপাতালে আসবে এবং বুকের সংক্রমণসহ নানা কিছুর চিকিৎসা নিতে চাইবে। কিন্তু আমাদের এখানে তেমনটি কখনই ঘটেনি।’
খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগবে, নভেল করোনাভাইরাস রুখতে যেখানে গোটা বিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে সেখানে ভিয়েতনাম কী করে এই মহামারী থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারল? জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সাফল্য এসেছে মূলত কয়েকটি বিষয়ের সমন্বিত প্রচেষ্টায়। শুরু থেকেই সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ, জোরদার কন্টাক্ট ট্রেসিং, কোয়ারেন্টিন ও কার্যকর গণযোগাযোগ।
শুরুর দিকের তৎপরতা:
এমনকি দেশে যখন একটিও করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়নি তখন থেকেই এর ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে ভিয়েতনাম সরকার। ওই সময় চীন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উভয়ই জানায়, একজন মানুষ থেকে আরেকজন মানুষের দেহে করোনাভাইরাস ছড়ায় কিনা সে ব্যাপারে পরিষ্কার কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। কিন্তু এ নিয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চাইল না ভিয়েতনাম। হ্যানয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড এপিডেমিওলোজির ইনফেকশন কন্ট্রোল বিভাগের উপ-প্রধান পাম কুয়াং বলেন, ‘আমরা শুধুই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করিনি। শুরুর দিকে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে আমরা দেশে ও দেশের বাইরে থেকে নানা ধরণের তথ্য জড়ো করা শুরু করি।’
জানুয়ারির শুরুর দিকেই চীনের উহান থেকে হ্যানয়গামী বিমানযাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা মাপার পর সন্দেহজনক হলে তাদের আইসোলেশন কিংবা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়, যা নিয়ে ওই সময় দেশটির শীর্ষ সংবাদমাধ্যম প্রতিবেদনও প্রকাশ করে।
মধ্য জানুয়ারিতে দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী ডু ডুক ডাম সরকারি সব সংস্থাকে তড়িত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন যাতে নভেল করোনাভাইরাস দেশব্যাপী ছড়াতে না পারে। তিনি সীমান্ত গেট, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরে কোয়ারেন্টিন সেন্টার খোলার নির্দেশ দেন।
২৩ জানুয়ারি ভিয়েতনামে দুজন মানুষের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় এবং তারা দুজনই চীনা নাগরিক। ভিয়েতনামে বসবাসকারী এক চীনাকে দেখতে তার বাবা আসেন উহান থেকে। এই দুজনই আক্রান্ত শনাক্ত হন। পরের দিনই উহানের সঙ্গে সব বিমান ফ্লাইট বাতিল করে ভিয়েতনাম বিমান কর্তৃপক্ষ।
নববর্ষের উদযাপনের সময় প্রধানমন্ত্রী নগুয়েন জুয়ান ফুক করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ২৭ জানুয়ারি কমিউনিস্ট পার্টির এক বৈঠকে তিনি বলেন, ‘এই মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের মতোই।’
তিন দিন পর তিনি করোনাভাইরাস রুখতে একটি জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটিও গঠন করেন, যেদিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাস নিয়ে বিশ্বব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে।
১ ফ্রেব্রুয়ারি মাত্র ছয়জন শনাক্ত হলেও কভিড-১৯-কে জাতীয় মহামারী হিসেবে ঘোষণা দেয় ভিয়েতনাম এবং চীনের সঙ্গে সব বিমান যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তখন দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান ও ইতালির সঙ্গেও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, কঠোর কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা কার্যকর হয়। মার্চের শেষ নাগাদ অবশ্য সব বিদেশির প্রবেশই নিষিদ্ধ করে দেশটি।
লকডাউন বাস্তবায়নেও প্রশংসা কুড়িয়েছে ভিয়েতনাম। ১২ ফেব্রুয়ারি সাতজন রোগী শনাক্ত হওয়ায় ১০ হাজার মানুষের একটি গ্রামকে ২০ দিনের জন্য পুরোপুরি লকডাউন করে রাখা হয়, চীনের বাইরে যা ছিল অন্য কোনো দেশের বৃহৎ লকডাউনের ঘটনা। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ফেব্রুয়ারিতে খোলার কথা থাকলেও তা মে মাস পর্যন্ত বন্ধ করার নতুন ঘোষণা আসে।
ডা. গাই মনে করেন, ভিয়েতনামের সফলতার নেপথ্যে রয়েছে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ। তার কথায়, ‘জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে ভিয়েতনামের নেয়া ব্যবস্থা ছিল অন্য বহু দেশের তুলনায় বেশ অগ্রগণ্য এবং এটা বেশ ফলপ্রসূ হয়…সরকারও এর মধ্য দিয়ে ভাইরাসের নিয়ন্ত্রণ নিতে সমর্থ হয়।’
সূত্র: সিএনএন
Leave a Reply