আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল :
জেলার উজিরপুর উপজেলার পশ্চিম সাতলা গ্রামে অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত মায়ের দোয়া ক্লিনিকের ভুয়া এমবিবিএস ডাক্তার মোঃ রেজাউল করিমকে এক নারীকে যৌন হয়রানীর অভিযোগে বুধবার সন্ধ্যায় গ্রেফতার করেছে উজিরপুর থানা পুলিশ।
থানা পুলিশ ও নির্যাতিত নারীর মামলার এজাহারে জানা গেছে, গত ১১ আগষ্ট দুপুরে মাদারীপুর জেলার রাজৈর থানার সুতারকান্দি গ্রামের রহিম বেপারীর স্ত্রী মায়া বেগম (৪০) মুখে ও গলায় ইনফেকশন নিয়ে মায়ের দোয়া ক্লিনিকে ভর্তি হয়। ১৩ আগষ্ট অসুস্থ্য মায়া বেগমকে সুস্থ্য করার জন্য তার ছোট বোন বিউটি আক্তার (২৫) ওই ক্লিনিকে আসলে সুচতুর লম্পট রেজাউল করিম কৌশলে বিউটি আক্তারের মোবাইল ফোন থেকে তার নাম্বারটি নিয়ে নেয় এবং ওইদিন রাত সাড়ে ১২ টায় ফোন করে বিউটিকে ওই ক্লিনিকের ছাদে যেতে বলে। পরেরদিন ১৪ আগষ্ট একইভাবে গভীর রাতে রেজাউল বিউটিকে ফোন করে ক্লিনিকের দোতলায় একটি রুমে ডাকে।
লম্পট রেজাউলের ডাকে বিউটি আক্তার সারা না দিলে পরেরদিন ১৫ আগষ্ট দিনের বিভিন্ন সময় রেজাউল খুব কৌশলে বিউটিকে ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। তাতেও কোনো কাজ না হলে ১৫ আগষ্ট রাত দেড়টায় দিকে (ওয়ার্ডের সকল রোগীরা ঘুমিয়ে পরলে) অন্ধকার ওয়ার্ডের ভিতর ঢুকে লম্পট রেজাউল করিম ঘুমন্ত বিউটি আক্তারের শরীরের বিভিন্ন স্পর্স কাতর স্থানে হাত দেয়। ঘুমের ঘোরে বিউটি হঠাৎ ভয় পেয়ে জেগে উঠে চিৎকার চেচামেচি করলে রেজাউল দ্রুত স্থান ত্যাগ করে ক্লিনিকের ছাদে গিয়ে আবার বিউটিকে ফোন করে ছাদে ডাকে। এ সময় বিউটি তার মোবাইল ফোনে লম্পট রেজাউলের সকল কথা রেকর্ড করেন। পরেরদিন ১৬ আগষ্ট সকালে রেজাউল বুঝতে পারে যে বিউটি ও তার বোন রোগী মায়া বেগম শক্ত ও সাহসী মনের অধিকারী। এটা বুঝে রেজাউল কৌশলে মায়া ও বিউটিকে তার ক্লিনিকে ১৯ আগষ্ট পর্যন্ত আটক করে রাখে। পরে মায়া বেগমের এক আত্মীয় ১৯ আগষ্ট বিকেলে বিষয়টি জানতে পেরে উজিরপুর থানায় হাজির হয়ে থানা পুলিশের সহযোগিতায় ওইদিন সন্ধ্যায় ক্লিনিকে ভর্তি মায়া বেগম ও তার বোন বিউটি আক্তারকে উদ্ধার করে এবং রেজাউলকে আটক করে থানায় নিয়ে এসে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের করেন (মামলা নং ২৫)।
ঘটনার আলোকে আরও জানা গেছে, বানারীপাড়ার ইলুহার গ্রামের দিন মজুর ফোরকান মিয়া তার ছয় বছরের শিশুপুত্র হাসানের পায়ুপথে সমস্যা দেখা দিলে সে হাসানকে নিয়ে রেজাউলের কাছে ডাক্তার দেখাতে গেলে অদক্ষ রেজাউল শিশু হাসানের পায়ুপথে কাটাছেরা করে সারাজীবনের জন্য হাসানের পায়ুপথ নষ্ঠ করে ফেলে এবং হাসান যখন মৃত্যুপথযাত্রী রেজাউল তখন তার দিনমজুর বাবা ফোরকান মিয়ার কাছ থেকে ১৮ হাজার টাকা নিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে ক্লিনিক থেকে তাড়িয়ে দেয়। পরে বিগত ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই ফোরকান মিয়া বাদী হয়ে ভুয়া ডাক্তার রেজাউলের নামে বরিশালের বিজ্ঞ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে।
পশ্চিম সাতলা গ্রামের দিনমজুর মৃত আদম আলী সরদারের ছোট ছেলে মোঃ রেজাউল ২০০৩ সালে আগৈলঝাড়া উপজেলার বাগধা দাখিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল (এসএসসি) পাস করে। এরপরে সে বিলের শাপলা সালুক তুলে বিক্রি করে জিবিকা নির্বাহ করতো। হঠাৎ করে সে নিজেকে গায়েবি ডাক্তার পরিচয় দিয়ে ডাক্তার সাজতে থাকে। এরপরে সে ২০০৭ সালে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ০৪-০-১১-১৬৫-০২৩ নম্বরের ষ্টুডেন্ট আইডির সিরিয়াল নম্বর থেকে নিজ নামে একটি এইচএসসি পাসের সনদপত্র বের করেন। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব সাইড খুঁজে ওই ষ্টুডেন্ট আইডি নম্বরটি মানিকগঞ্জের মোতিলাল ডিগ্রী কলেজের একজন ছাত্র মোহাম্মদ মোশারেফ হোসাইনের নামে পাওয়া যায়। সুতরাং স্পষ্টতই বোঝা যায় যে রেজাউলের এইচএসসি পাসের সনদপত্রটি জাল বা ভুয়া। এরপরে সে নিজেকে এমবিবিএস ডাক্তার হিসাবে জাহির করে এবং পিচ বেøন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিবিএস পাসের সনদপত্র সংগ্রহ করে। ওই সনদপত্রগুলো পর্যবেক্ষন করে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তালিকায় পিচবেøন্ড ইউনিভার্সিটির কোনো নাম নেই এবং দেশের একমাত্র আইনগত সংস্থ্যা বিএমডিসিরও কোনো অনুমোদন নেই। এতে স্পটতই বোঝা যায় তার এমবিবিএস পাসের সনদগুলোও জাল জালিয়াতি করে অবৈধ উপায়ে সংগ্রহ করা হয়েছে। এ সকল ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে উজিরপুর উপজেলার পশ্চিম সিমান্ত ও গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার পূর্ব সিমান্তের অজ পাড়া গাঁ শাপলা সালুক আর সবজি উৎপাদনের বিল হিসেবেখ্যাত পশ্চিম সাতলা গ্রামে ভন্ড লম্পট রেজাউল নিজেকে এমবিবিএস ডাক্তার সাজিয়ে সেখানে গড়ে তুলেছে এক আলিসান দ্বিতল ভবন। যেখানে তৈরী করেছে সে মানুষ মারার টর্চার সেল, যার নাম দিয়েছে “মায়ের দোয়া ক্লিনিক ও ডিজিটাল ডায়াগষ্টিক সেন্টার”। এই ক্লিনিকে সে রোগীদের স্বজনদের কাছ থেকে জোর করে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়ার জন্য একটি শক্তিশালী সন্ত্রাসী বাহিনীও লালন পালন করছেন। ওই সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান হিসেবে সব কিছু নিয়ন্ত্রন করে রেজাউলের বড় ভাই রুহুল আমিন। সে নিজেকে সব জায়গায় ওলামা লীগের সভাপতি হিসেবে পরিচয় দিয়ে অনৈতিক সুবিধা আদায় করে নেয়।
অন্যদিকে ভুয়া ডাক্তার রেজাউলের বিরুদ্ধে হয়রানির স্বীকার হওয়া শত শত মানুষের অভিযোগ রয়েছে, যা দেশের বিভিন্ন তদন্ত সংস্থ্যা নিবিরভাবে তদন্ত করলেই থলের বিরাল বেরিয়ে আসবে। সাতলা এলাকার লোকজন ইতোমধ্যে ঢাকায় রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদের থেকেও রেজাউলকে ভয়ংকর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে রেজাউল তার ক্লিনিকে বরিশাল-২ আসনে যে যখন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তখন সেই সাংসদের সাথে ছবি তুলে তা ওই ক্লিনিকের সামনের ফটোকে লাগিয়ে রেখে নিজেকে এমপি খুব কাছের লোক হিসেবে জাহির করেন। বর্তমানে বরিশাল-২ আসনের সাংসদ মোঃ শাহে আলমের সাথে ছবি তুলে টানিয়ে রেখেছে। তার আগের সাবেক সাংসদদের সাথেও ছবি তুলে টানিয়ে রেখেছিলো রেজাউল।
ভুয়া ডাক্তার রেজউলকে আটক ও ভিকটিমকে উদ্ধারের পুরো ঘটনাটি মনিটরিং করছেন বরিশালের সহকারী পুলিশ সুপার উজিরপুর সার্কেল আবু জাফর মোহাম্মদ রহমতউল্লাহ।
এ বিষয়ে উজিরপুর মডেল থানাও ওসি মোঃ জিয়াউল হাসান বলেন, রেজাউলের নামে প্রায় অর্ধশত অভিযোগের খবর পাওয়া গেছে। সকল অভিযোগের ব্যাপারে পুলিশের তদন্ত করছে।
Leave a Reply